নিবেদিতা হালদার গাঙ্গুলির উপন্যাস “মেঘাচ্ছন্ন আকাশ”
ধারাবাহিক উপন্যাসঃ প্রথম ভাগ
*প্রথম খণ্ড*
(১)
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া – মেঘে ঢেকে আছে। বৃষ্টি সেই সকাল সাতটায় স্কুল গেছে। সূর্য আটটায় অফিস গেছে। বৃষ্টি আসবে বিকেল চারটায়। বৃষ্টি স্কুলেই ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ খায়। চারটেয় ফিরে দুধ খায় কার্টুন দেখতে দেখতে। আমি টিউশন দি বিকেল পাঁচটা থেকে আটটা অব্দি। বৃষ্টির সাথে আরও কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে কে পড়াই। আটটার পর রান্না বসাই, দশ টা বেজে যায় রান্না হতে হতে। বৃষ্টি আমার সাথে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে, নইলে বই পড়ে, নইলে ছবি আঁকে। আর অনবরত কথা বলতে থাকে – স্কুলের গল্প – কোন বন্ধু কি টিফিন আনল, কে কাকে মারল, কোন ম্যাম কাকে কি বলেছে – এইসব। সূর্যর ফিরতে ফিরতে কম করে রাত দশ টা হয়ই। অফিস পার্টি থাকলে আরও রাত হয়। দশ টায় আমি আর বৃষ্টি খেয়ে নি। সূর্য কখন খাবে, আদৌ খাবে নাকি, খেলে কতটা খাবে কিছু ঠিক নেই। বৃষ্টিকে শুইয়ে স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে ফ্রিজে খাবার তুলতে তুলতে আমার এগারোটা বেজে যায়। তারপর আমি শুয়ে বই পড়ি। ঘুম আসে বারোটা নাগাদ।
ঘুম ভাঙ্গে ভোর পাঁচটায় অ্যালার্মের আওয়াজে। তারপর দৌড় ঝাঁপ – টিফিন বানাও, টিফিন বক্স গোছাও, বৃষ্টি কে ছয়টায় তুলে রেডি কর, সাতটায় বাসে তুলে দাও, তারপর ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দিয়ে ব্রেকফাস্ট কর। আটটায় সূর্য বেড়িয়ে যায় আর মালতি আসে। নটায় মালতি বেড়িয়ে গেলে আমি একটু দম নি। তারপর থেকে চারটে অব্দি আমার একা থাকার সময়।
ফেসবুকে সবাই আছে, আমিও আছি। স্কুলের বন্ধু, কলেজের বন্ধু, আর আরও অনেকে – ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডস। অনেকগুলো গ্রুপের মেম্বার আমি – সময় কেটে যায়। মাঝেসাজে লিখি, বই পড়ি, সিনেমা দেখি, গান শুনি, ফটো দেখি – সময় কাটানো কোনো ব্যাপার নয়। হাঁ টিভিও দেখি, সেটা ভীষণ কম। হালে আমার একটি নতুন বন্ধু হয়েছে – আকাশ। অনেক বন্ধু আছে, মাঝে মাঝে চ্যাটে কথাও বলি, কিন্তু কখনও কাউকে আমি মিস করিনা। তারাই আমায় পিং করে, আমি উত্তর দি। এই আকাশ কিন্তু অন্যরকম। প্রথমদিনই চ্যাটে লিখল – “হাই, আমি ব্যবসা করি, সময় খুব কম। ফেসবুকে বিশেষ আসিনা। এই নাও আমার নাম্বার, whatsapp কোরো”। এরপর নাম্বার দিয়ে বাই বাই বলে লগ আউট করে দিলো। অদ্ভুত! তারপর দিন তিনেক তাকে আর আমি অনলাইন দেখলাম না, না তার কোনো আপডেট পেলাম। একটা অদম্য কৌতূহল হল। আমি সকালে whatsapp এ একটা গুড মর্নিং মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। ওমা! সঙ্গে সঙ্গে ফোন –
“হ্যালো!”
“হেই মেঘা, এতদিনে মনে হল আমায় contact করবে?”
“না মানে, মনে হয়েছিল, ফেসবুকে আসবে”।
“সময় নেই, ওই টাইপ করার”।
“ওহ!”
“এখন বাজে নয়, আমি বেরবো। দশটায় তোমায় ফোন করছি”।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন কেটে দিলো। অদ্ভুত!
(২)
সেই শুরু – ওই রোজ ফোন করে, দশটায় ফোন না করলে মেসেজ করে – ‘busy, catch u later’ তারপর হয়তো আর সারাদিনে ফোন করলই না। রাতে মেসেজ করে – ‘so sorry dear, was damn busy! Hope u didn’t mind, damn tired, gn.’ আমি উত্তরে একটা গুড নাইট পাঠিয়ে দি। কি কথা বলি আমরা? হিজিবিজি। আমি বলি কি রান্না করব, কি রেঁধেছিলাম, বর কটায় ফিরল, মদ খেয়ে ফিরেছিল নাকি, মেয়ে স্কুলে কি করেছে – এই সব। আর ও? ওর রান্নার মহিলা জ্বালাচ্ছে, লেট করছে, অফিস যেতে লেট হচ্ছে, অফিসের কোন ছেলে কাজ করছে না, কোন ক্লায়েন্ট ঝাড় দিচ্ছে, সব কটাকে স্যাক করে দেবে, অফিস বেচে হিমালয়ে যাবে, এই সব। মাঝে মাঝে ও মদ খায়। সেদিন রাতে মেসেজ করতেই থাকে, করতেই থাকে – কথা বলব, প্লিজ, টয়লেটে যাও না, ব্যাল্কনিতে যাও না, রান্নাঘরে যাও না, বাইরের ঘরে যাও না, যেখানে পারো যাও, বরকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াও না – এইসব! পাগলার জন্য সেদিন আমার গভীর রাতে টয়লেট পায়, নইলে জল পিপাসা পায়, নইলে রান্নাঘরের জানলা বন্ধ করেছি কিনা দেখতে যেতে হয়। সেদিন করে আমায় ফোনে একটা চুমু দিতেই হয়, নইলে সে ফোন কাটতেই চায় না! আমার বর রোজই এক-দুই পেগ করে মদ খায়, তাই গভীর ঘুমায়, তাও ভয় লাগে কেমন একটা, যদি বুঝে যায়?
একদিন সকালে ফোন করে আকাশ আমায় ওর অফিসে যেতে বলল। ওর স্বভাব এটা, দুম করে প্ল্যান করা – “অ্যাই, তোমায় দেখব। আমার অফিসে এস”।
“কি কাণ্ড! এক্ষুনি?”
“হাঁ, এক্ষুনি। অফিসে ঢুকবে না, উল্টোদিকের ফুটে একটা বারিস্তা আছে, ওটায় বসে থাকবে”।
গেলাম সেদিন। কি ঝামেলা – চুলে শ্যাম্পু করা নেই, কোনও রকমে গায়ে জল ঢেলে একটা সাধারণ কুর্তা আর লেগ-ইন পরে হাজির হলাম। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করছিল – কেন কে জানে? ও এল। খুব সহজভাবেই একগাল হেসে আমার পাশের সোফাটায় বসে পড়ল। “কি খাবে?” “আমার ক্ষিদে পাচ্ছে না”, মিনমিন করে বললাম। “ও বললে হয় নাকি!” বলেই দুটো কফি, দুটো মাফিন অর্ডার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসল – “মেয়ে চারটেয় আসবে তো? অনেক সময়, সবে এগারোটা বাজে”।
“তোমার আজ কাজ নেই?”
“কাজ আবার নেই? ইচ্ছে করল তোমার সাথে দেখা করি। ফোনে তো অনেক কথা হল! তোমার ইচ্ছে ছিল না বুঝি?”
“না, তা কেন?”
“হুম! এরকম আর কজনের সাথে দেখা করেছ?” বলেই মুচকি হাসল। আমার একটু রাগ ধরল! বললাম, “আমি যার তার সাথে যখন তখন দেখা করি না!”
“Ok! Then I’m a special person! I’m privileged!”
“তুমি বন্ধু”।
“হায় রে! শুধুই বন্ধু? দুঃখ পেলাম”।
“প্লিজ! আর কি হবে?”
“কেন? আমি তোমার কৃষ্ণ হব, তুমি আমার রাধা হও”।
“পারলাম না”।
“ওকে” বলে হে হে করে হাসতে থাকল, চারপাশের লোকজন টেরিয়ে টেরিয়ে আমাদের দেখতে লাগলো। মনে হল দি একটা ঘুষি! “এই, এত জোরে হেসো না তো!”